আব্বাস কিয়রোস্তামি
আব্বাস কিয়রোস্তামি | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ৪ জুলাই ২০১৬ প্যারিস, ফ্রান্স | (বয়স ৭৬)
পেশা | চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, কবি, চিত্রকর, আলোকচিত্রশিল্পী |
কর্মজীবন | ১৯৭০ - বর্তমান |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | টেস্ট অব চেরি, হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম?, ক্লোজ-আপ |
দাম্পত্য সঙ্গী | পারভিন আমির-গুলি (১৯৬৯-৮২) |
সন্তান | বাহমান কিয়রোস্তামি (জন্ম: ১৯৭৮) |
আব্বাস কিয়ারোস্তামি (ফার্সি: عباس کیارستمی [ʔæbˌbɒːs kijɒːɾostæˈmi] (; ২২ জুন ১৯৪০ – ৪ জুলাই ২০১৬) ছিলেন একজন বিশ্বখ্যাত )ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, কবি, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রশিল্পী।[১][২][৩] ১৯৭০ সাল থেকে নিয়মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য সব ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাচ্ছেন তিনি। কোকের ত্রয়ী, টেস্ট অব চেরি এবং দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস এর মত সিনেমার জন্য আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন, এর মধ্যে টেস্ট অব চেরি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দোর অর্জন করেছে।
তিনি আধুনিক চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম ওটার, অর্থাৎ তিনি নিজের সিনেমার সবকিছুই প্রায় নিজের হাতে করেন। রচনা, পরিচালনা, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, সঙ্গীত ও শব্দ সংযোগ সবকিছুতেই তার একচ্ছত্র প্রভাব থাকে। সিনেমার পাশাপাশি কবিতা, চিত্রশিল্প এবং গ্রাফিক ডিজাইন এর জগতেও তার পদচারণা রয়েছে।
কিয়রোস্তামি ১৯৬০-এর দশক থেকে ইরানের চলচ্চিত্রাঙ্গণে শুরু হওয়া ইরানি নবতরঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। এই আন্দোলনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ফারুগ ফারোখ্জদ, সোহরাব শহিদ সলেস, মোহসেন মাখমালবফ, বহরম বেইজাই এবং পারভেজ কিমিয়ভি। তাদের নির্মাণ কৌশলে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন কাব্যিক চিত্রনাট্য, রূপক গল্প, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক চিন্তাধারার প্রতিফলন।[৪]
এর মধ্যে কিয়রোস্তামির সিনেমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিশু চরিত্রের প্রাধান্য, প্রামাণ্য চিত্রের মত সিনেমাটোগ্রাফি,[৫] গ্রাম্য এলাকায় শুটিং এবং গাড়ি বিশেষ করে ব্যক্তিগত কারের ভেতর কথোপকথন। তিনি অনেক সময়ই গাড়ির ভেতর রাখা একটি স্থির ক্যামেরায় চালক এবং যাত্রীর কথোপকথন ধারণ করেন। সমসাময়িক ইরানি কবিতার প্রভাব তার সিনেমায় খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়।
জীবনের প্রথম ভাগ
[সম্পাদনা]কিয়রোস্তামির জন্ম ইরানের রাজধানী তেহরানে। শিল্পের সাথে তার প্রথম পরিচয় চিত্রকলার মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা শুরু করেন যার ফলশ্রুতিতেই ১৮ বছর বয়সে লাভ করেন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। এর কিছুদিন পরই বাড়ি ছেড়ে তেহরান চলে যান তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়ার জন্য।[৬] সেখানে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে কাজ করে নিজের খরচ নিজেই বহন করেন, ডিগ্রি অর্জন করেন মূলত চারুকলা এবং গ্রাফিক ডিজাইনে। চিত্রকর, নকশাবিদ ও অঙ্কনবিদ হিসেবে ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তিনি ইরানি টেলিভিশনের জন্য প্রায় ১৫০টি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এই দশকের শেষের দিকে সিনেমার নাম ও ক্রেডিট ডিজাইন শুরু করেন এবং শিশুতোষ গ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কন শুরু করেন। তার এই অভিজ্ঞতা অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনিও পেশাজীবন শুরু করেছিলেন অঙ্কনবিদ ও শিশুতোষ গ্রন্থ ও সাময়িকীর প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। কিয়রোস্তামি মাসুদ কিমিয়াই এর গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা কায়সার (১৯৬৯) এর ক্রেডিট ডিজাইন করেছিলেন।[৬]
১৯৬৯ সালেই আব্বস পারভিন আমির-গুলি কে বিয়ে করেন যদিও ১৯৮২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাদের দুটি সন্তান হয়েছিল, ১৯৭১ সালে আহমদ এবং ১৯৭৮ সালে বাহমান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাহমান কিয়রোস্তামি জার্নি টু দ্য ল্যান্ড অব দ্য ট্র্যাভেলার (১৯৯৩) নির্মাণের মধ্য দিয়ে চিত্রপরিচালক ও চিত্রগ্রাহকে পরিণত হন।
১৯৭৯ সালের যুগ পরির্বতনকারী ইরানি বিপ্লবের পর মাত্র গুটিকয়েক চলচ্চিত্রকার ইরানে থেকে গিয়েছিলেন যাদের মধ্যে আব্বস একজন। অধিকাংশ নির্মাতাই পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে যান। কিন্তু আব্বস বিশ্বাস করেন দেশে থাকাটাই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভাল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, ইরানে থেকে নিজের জাতীয় পরিচয় ও সত্ত্বা আঁকড়ে থাকার কারণে তার চলচ্চিত্র জীবন মহিমাণ্ডিত হয়েছে:
“ | মূলোৎপাটিত করে একটি গাছকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে সে আর ফল দেবে না। অন্তত আপন স্থানে সে যত ভাল ফল দিত নতুন স্থানে তত ভাল দেবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি মনে করি দেশ ছেড়ে গেলে আমার অবস্থা হতো সেই গাছের মত। - আব্বস কিয়রোস্তামি[৭] | ” |
আব্বসকে হরহামেশাই গাঢ় কালো চশমা তথা সানগ্লাস পরে থাকতে দেখা যায়। চোখের আলোক সংবেদনশীলতায় সমস্যা থাকার কারণে ডাক্তারের পরামর্শে তিনি এটা পরেন।[৮]
২০০০ সালে সান ফ্রানসিস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার-টি তিনি আরেক ইরানি চলচ্চিত্রকার বেহরুজ বসুগি-কে উৎসর্গ করেন যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। ইরানি চলচ্চিত্রে বসুগির অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপই তিনি এমনটি করেছিলেন।[৯]
চলচ্চিত্র জীবন
[সম্পাদনা]১৯৭০ দশক: ইরানি নবতরঙ্গের সূচনা
[সম্পাদনা]১৯৬৯ সালে দারিয়ুশ মেহরুজির বিখ্যাত সিনেমা গব এর মাধ্যমে যখন ইরানি নবতরঙ্গের যাত্রা শুরু হয় তখন কিয়রোস্তামি নিজের চেষ্টায় কানুন (Institute for the Intellectual Development of Children and Young Adults)-এ চলচ্চিত্র বিভাগ গঠন করেন। কানুনে নির্মীত তার প্রথম সিনেমা ছিল ১২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চিত্র ব্রেড এন্ড অ্যালি (১৯৭০)। নব্য বাস্তবতাবাদী এই ছবির কাহিনী দোকান থেকে রুটি কিনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে থাকা এক শিশুর সাথে রাস্তায় একটি কুকুরের মোকাবেলা নিয়ে। এরপর ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন ব্রেকটাইম। এক পর্যায়ে কানুন ইরানের একটি অগ্রগামী চলচ্চিত্র স্টুডিওতে পরিণত হয়। আব্বসের পাশাপাশি তারা ইরানের অন্যান্য বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সিনেমাও প্রযোজনা করতে শুরু করে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্য রানার এবং বাসু, দ্য লিটল স্ট্রেঞ্জার।[৬]
সত্তরের দশকে ইরানি সিনেমার নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে আব্বস একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক তথা ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট অবস্থান গ্রহণ করেন, নৈতিক দিক দিয়ে প্রতিটি ব্যক্তির গুরুত্ব তার কাছে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।[১০] এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
“ | সিনেমার জগৎে ব্রেড এন্ড অ্যালি আমার প্রথম অভিজ্ঞতা এবং বলতেই হয় সেটি ছিল খুব কঠিন। আমাকে কাজ করতে হয়েছিল একটি শিশু, একটি কুকুর এবং চিত্রগ্রাহক বাদ দিলে একটি অপেশাদার ক্রু নিয়ে। তারা সবাই সর্বদা এটা ওটা নিয়ে অভিযোগ করে যাচ্ছিল। আর চিত্রগ্রাহক চলচ্চিত্রায়নের যে কৌশলের সাথে পরিচিত ছিল তা আমি ব্যবহার করিনি।[১১] | ” |
১৯৭৩ সালে দি এক্সপেরিয়েন্স নির্মাণের পর কিয়রোস্তামি ১৯৭৪ সালে তৈরি করেন দ্য ট্র্যাভেলার বা মুসাফির। মুসাফিরের কাহিনী একটি ছোট্ট ইরানি শহরের ঝামেলা সৃষ্টিকারী এক ১০ বছরের শিশুকে নিয়ে। সে তেহরানে ইরানের জাতীয় ফুটবল দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলা দেখতে বদ্ধপরিকর। এজন্য সে বন্ধু ও প্রতিবেশিদের সাথে ছল-চাতুরী করে এবং কিছু এডভেঞ্চারের পর অবশেষে খেলা শুরুর আগে তেহরান স্টেডিয়ামে পৌঁছতে সক্ষম হয়। সিনেমাটিতে ছেলেটির দৃঢ়সংকল্প এবং অন্যদের উপর (বিশেষ করে তার নিকটাত্মীয়) তার কাজের প্রভাব সম্পর্কে তার ঔদাসীন্য ফুটে উঠেছিল। এটি ছিল মানুষের ব্যবহার এবং ভুল-শুদ্ধের ভারসাম্য নিয়ে একটি পরীক্ষা। বাস্তবতাবাদ, ডাইজেটিক সরলতা, জটিল নির্মাণ শৈলির এবং ভৌত বা আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার প্রি মুগ্ধতা- এই বিষয়গুলোতে কিয়রোস্তামির দক্ষতা এই সিনেমার মাধ্যমে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[১২]
১৯৭৫ সালে তিনি দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সো ক্যান আই এবং টু সল্যুশনস ফর ওয়ান প্রবলেম। ১৯৭৬ সালের শুরুতে তার পরিচালনায় মুক্তি পায় কালারস সিনেমাটি, এর পরে নির্মাণ করেন ৫৪ মিনিটের চলচ্চিত্র আ ওয়েডিং স্যুট। ওয়েডিং স্যুটের কাহিনী তিনজন কিশোরকে কেন্দ্র করে যারা একটি বিয়ের পোশাক নিয়ে দ্বন্দ্ব্বে জড়িয়ে পড়ে।[১৩] কিয়রোস্তামির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিল ১১২ মিনিটের দ্য রিপোর্ট যা ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়। এর কাহিনী ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে নিয়ে, এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু ছিল আত্মহত্যা। ১৯৭৯ সালে তার প্রযোজনা এবং পরিচালনায় মুক্তি পায় ফার্স্ট কেইস, সেকেন্ড কেইস ছবিটি।
১৯৮০-র দশক
[সম্পাদনা]১৯৮০-র দশকের শুরুতে কিয়রোস্তামি বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে ডেন্টাল হাইজিন (১৯৮০), অর্ডারলি অর ডিসঅর্ডারলি (১৯৮১) এবং দ্য কোরাস (১৯৮২)। ১৯৮৩ সালে পরিচালনা করেন ফেলো সিটিজেন। অবশ্য এর সব কয়টিই মূলত ইরানের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৮৭ সালে হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? নির্মাণের মাধ্যমে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন কিয়রোস্তামি।
হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? সিনেমার কাহিনী অতিরিক্ত রকমের সহজ-সরল। মূল চরিত্র একটি আট বছর বয়সের স্কুল ছাত্র যাকে তার বন্ধুর নোটখাতা ফিরিয়ে দিতে হবে। স্কুল থেকে ভুলে সে এটা নিয়ে এসেছে এবং আগামী কালের স্কুলের আগে ফেরত দিতে না পারলে তার বন্ধু বাড়ির কাজ করতে পারবে না এবং তাকে স্কুল থেকে বের করেও দেয়া হতে পারে। বন্ধুর বাড়ি পাশের গ্রামে, কিন্তু বাড়িটি সে চেনে না। একেক জনের কাছে জিজ্ঞেস করে সে খাতা নিয়ে বাড়িটি খুঁজতে থাকে। এতে ইরানের গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বারংবার ইরানের গ্রাম্য দৃশ্য তুলে ধরা এবং সহজ-সরল বাস্তবতা এই ছবির মূল বৈশিষ্ট্য, এ দুটোকে কিয়রোস্তামির সিনেমার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। এছাড়া সিনেমাটি নির্মীত হয়েছে পুরোপুরি একজন বালকের দৃষ্টিকোণ থেকে, শিশুতোষ অনেক সিনেমায় যেমন বড়দের প্রভাব ফুটে উঠে এতে তেমনটা হয়নি।[১৪]
চলচ্চিত্র সমালোচকরা কিয়রোস্তামির হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম?, অ্যান্ড লাইফ গোস অন (১৯৯২) (লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর... নামেও পরিচিত) এবং থ্রু দি অলিভ ট্রিস (১৯৯৪) সিনেমা তিনটিকে কোকের ত্রয়ী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ সবগুলো সিনেমায় উত্তর ইরানের কোকের নামক একটি গ্রামকে কেন্দ্র করে। সিনেমাগুলোর ভিত্তি ১৯৯০ সালের মনজিল-রুদবার ভূমিকম্প যাতে ৪০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। কিয়রোস্তামি জীবন, মরণ, পরিবর্তন এবং সন্ততি এই থিমগুলোর মাধ্যমে তিনটি সিনেমাকে যুক্ত করেছেন। ১৯৯০-এর দশকে ফ্রান্সে সিনেমা তিনটি খুব সফল মুক্তি লাভ করে এবং নেদারল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি এবং ফিনল্যান্ড এর মত দেশগুলোতেও প্রশংসিত হয়।[১২] অবশ্য কিয়রোস্তামি নিজে সিনেমা তিনটিকে কোন ত্রয়ীর অংশ বলে মনে করেন না। এমনকি তার মতে, শেষ দুটো সিনেমা এবং টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭) একসাথে একটি ত্রয়ী হতে পারে। কারণ তাদের একটি সাধারণ থিম আছে যা হল অমুল্য জীবন।[১৫] ১৯৮৭ সালে কিয়রোস্তামি দ্য কি সিনেমাটির চিত্রনাট্য লেখার সাথে যুক্ত ছিলেন, এর সম্পাদনাও তিনি করেন কিন্তু পরিচালনা করেননি। ১৯৮৯ সালে নির্মাণ করেন হোমওয়ার্ক।
১৯৯০-এর দশক
[সম্পাদনা]এই দশকে আব্বসের প্রথম সিনেমার নাম ছিল ক্লোজ-আপ (১৯৯০)। সত্য ঘটনা অবলম্বনে হওয়া এই সিনেমাতে দেখা যায় একজন ছদ্মবেশী চলচ্চিত্রকার একটি পরিবারের কাছে নিজেকে মোহসেন মাখমালবফ নামে পরিচয় দেয় এবং বলে তার পরবর্তী সিনেমায় এই পরিবারের সদস্যদের দিয়ে অভিনয় করাবেন। একসময় বুঝতে পেরে পরিবারটি তাকে চুরি-ডাকাতির দায়ে অভিযুক্ত করে। কিন্তু ছদ্মবেশী হোসেন সাবজিয়ান দাবী করেন ছদ্মবেশ ধারণের কারণ অনেক জটিল। আধা প্রামাণ্য আধা কল্পিত এই সিনেমায় সাবজিয়ানের মাখমালবফের ছদ্মবেশ ধারণের পেছনে নৈতিক দায়বদ্ধতা যাচাই করে দেখা হয় এবং তার সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক দক্ষতা বা নৈপুণ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।[১৬]ক্লোজ-আপ কুয়েন্টিন টারান্টিনো, মার্টিন স্কোরসেজি, ভের্নার হেরৎসগ, জঁ-লুক গদার এবং নান্নি মোরেত্তির মত পরিচালকদের কাছে প্রশংসিত হয়[১৭] এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুক্তি পায়।[১৮]
১৯৯২ সালে কিয়রোস্তামি নির্মাণ করেন লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর... যা সমালোচকদের মতে তার কোকের ত্রয়ীর দ্বিতীয় সিনেমা। এতে দেখা যায়, একজন বাবা তার বালক ছেলেকে নিয়ে তেহরান থেকে কোকের গ্রামে যাচ্ছেন নিজের গাড়ি চালিয়ে। উদ্দেশ্য, দুটি ছেলেকে খুঁজে বের করা যারা ভূমিকম্পে মারা গিয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করতে থাকে বাবা-ছেলে। ভূমিকম্পে বিধ্স্ত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তারা বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষের মুখোমুখি হয় যারা এত কষ্টের মাঝেও জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।[১৯][২০] সে বছর কিয়রোস্তামি এই সিনেমার জন্য প্রিক্স রোবের্তো রোজেলিনি পুরস্কার লাভ করেন। এটি ছিল তার চলচ্চিত্রকার জীবনের প্রথম পেশাদার পুরস্কার। তথাকথিত কোকের ত্রয়ীর শেষ সিনেমা ছিল থ্রু দি অলিভ ট্রিস (১৯৯৪)। এই সিনেমা লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর... এর একটি খুব ছোট ও সাধারণ দৃশ্য ধারণের কাহিনীকে কেন্দ্র করে।[২১]
অ্যাড্রিয়ান মার্টিনের মত চলচ্চিত্র সমালোচকরা কোকের ত্রয়ীর নির্মাণ পদ্ধতিকে ডায়াগ্রামাটিক্যাল (জ্যাতিমিক আকৃতিমূলক) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেমন, সিনেমায় দেখানো গ্রামের দৃশ্যগুলোকে আঁকাবাঁকা পথ এবং জীবন ও পৃথিবীর বিভিন্ন শক্তির জ্যামিতি বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট।[২২][২৩]লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর... (১৯৯২) এর আঁকাবাঁকা পথের ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যটি দর্শকদেরকে তার আগের সিনেমা হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? (১৯৮৭) এর কথা মনে করিয়ে দেয় যা ভূমিকম্পের আগে ধারণ করা হয়েছিল। এর সাথে আবার সম্পর্ক রয়েছে থ্রু দি অলিভ ট্রিস (১৯৯৪) এর একটি দৃশ্যের যা ভূমিকম্প পরবর্তী পুনর্নির্মাণ দেখায়।
১৯৯৫ সালে মাইরাম্যাক্স ফিল্মস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্রু দি অলিভ ট্রিস প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন শুরু করে। এর পর কিয়রোস্তামি "দ্য জার্নি" এবং "দ্য হোয়াইট বেলুন" (১৯৯৫) সিনেমা দুটির চিত্রনাট্য লিখেন যার দ্বিতীয়টি পরিচালনা করেন তার প্রাক্তন সহকারী জাফর পানাহি।[২৪] ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালের মধ্যে কিয়রোস্তামি আরও ৪০ জন চলচ্চিত্রকারের সাথে "লুমিয়ে অ্যান্য কোম্পানি" নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৯৭ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি টেস্ট অব চেরি সিনেমার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দোর অর্জন করেন।[২৫] এই সিনেমা জনাব বাদি নামক এক ব্যক্তিকে ঘিরে যিনি আত্মহত্যা করতে বদ্ধ পরিকর, তার পরিকল্পনা হচ্ছে অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের খননকৃত কবরে শুয়ে থাকবেন। কিন্তু সকালে এসে কাউকে তার দেহের উপর মাটি দিয়ে যেতে হবে। এমন একজনকেই তিনি প্রায় পুরো সিনেমা জুড়ে খুঁজে বেড়ান। এতে নৈতিকতা, আত্মহত্যার যৌক্তিকতা ও বৈধতা এবং দয়ার প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন কিয়রোস্তামি।[২৬]
চলচ্চিত্রসমূহ
[সম্পাদনা]পুরস্কার
[সম্পাদনা]আব্বস কিয়রোস্তামি সমগ্র ক্যারিয়ারে অনেকগুলো পুরস্কার জিতেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু পুরস্কারের নাম এবং প্রাপ্তির সন উল্লেখ করা হল:
- প্রিক্স রবের্তো রোজেলিনি (১৯৯২)
- ফ্রঁসোয়া ত্রুফো পুরস্কার (১৯৯৩)
- পিয়ের পাওলো পাসোলিনি পুরস্কার (১৯৯৫)
- ফেদেরিকো ফেলিনি স্বর্ণপদক, ইউনেস্কো (১৯৯৭)
- পাম দোর, কান চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৯৭)
- সম্মানসূচক গোল্ডেন আলেকজান্ডার প্রাইজ, থেসালোনিকি চলচ্চিত্রউৎসব (১৯৯৯)
- সিলভার লায়ন, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৯৯)
- আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার (২০০০)
- সম্মানসূচক ডক্টরেট, একোল নর্মাল সুপেরিয়র (২০০৩)
- বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি কর্তৃক কামেরা দোর, কান চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৫)
- ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর ফেলো (২০০৫)
- গোল্ড লেপার্ড অব অনার, লোকারনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৫)
- Prix Henri-Langlois Prize (২০০৬)
- ওয়ার্ল্ডস গ্রেট মাস্টার্স, কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৭)
- গ্লোরি টু দ্য ফিল্মমেকার এওয়ার্ড, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৮)
- সম্মানসূচক ডক্টরেট, ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস (২০১০)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Panel of critics (2003-11-14)। "The world's 40 best directors"। লন্ডন: Guardian Unlimited। সংগ্রহের তারিখ 2007-02-23। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|year= / |date= mismatch
(সাহায্য) - ↑ Karen Simonian (২০০২)। "Abbas Kiarostami Films Featured at Wexner Center" (পিডিএফ)। Wexner center for the art। ২০০৭-০৭-১০ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ "2002 Ranking for Film Directors"। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট। ২০০২। ২০১২-০৩-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ Ivone Margulies (২০০৭)। "Abbas Kiarostami"। Princeton University। ২০০৭-০৬-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ "Abbas Kiarostami Biography"। Firouzan Film। ২০০৪। ২০০৮-০৩-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ ক খ গ "Abbas Kiarostami: Biography"। Zeitgeist, the spirit of the time। ২০০৭-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ Jeffries, Stuart (২০০৫-১১-২৯)। "Landscapes of the mind"। London: Guardian Unlimited। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৮।
- ↑ Ari Siletz (২০০৬)। "Besides censorship"। Iranian.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৭।
- ↑ Jeff Lambert (২০০০)। "43rd Annual San Francisco International Film Festival"। Sense of Cinema। ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০১৮।
- ↑ Hamid Dabashi (২০০২)। "Notes on Close Up – Iranian Cinema: Past, Present and Future"। Strictly Film School। ২০০৭-০২-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ Shahin Parhami (২০০৪)। "A Talk with the Artist: Abbas Kiarostami in Conversation"। Synoptique। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ ক খ David Parkinson (২০০৫)। "Abbas Kiarostami Season"। BBC। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ "Films by Abbas Kiarostami"। Stanford University। ১৯৯৯। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১২।
- ↑ Chris Darke। "Where Is the Friend's Home?" (পিডিএফ)। Zeitgeistfilms। ২০০৭-০১-২৭ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৭।
- ↑ Godfrey Cheshire। "Taste of Cherry"। The Criterion Collection। ২০০৭-০৯-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ Jeffrey M. Anderson (২০০০)। "Close-Up: Holding a Mirror up to the Movies"। Combustible Celluloid। ২০১৯-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২২।
- ↑ "Close-Up"। Bfi Video Publishing। ১৯৯৮।
- ↑ Hemangini Gupta (২০০৫)। "Celebrating film-making"। The Hindu। ৫ আগস্ট ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১২।
- ↑ Jeremy Heilman (২০০২)। "Life and Nothing More… (Abbas Kiarostami) 1991"। MovieMartyr। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১২।
- ↑ Jonathan Rosenbaum (১৯৯৭)। "Fill In The Blanks"। Chicago Reader। ২৬ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০১২।
- ↑ Stephen Bransford (২০০৩)। "Days in the Country: Representations of Rural Space ..."। Sense of Cinema।
- ↑ Maximilian Le Cain। "Kiarostami: The Art of Living"। Film Ireland। ১০ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০১৮।
- ↑ "Where is the director?"। British Film Institute। ২০০৫। ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০১৮।
- ↑ "Abbas Kiarostami: Biography"। Zeitgeist, the spirit of the time। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ "Festival de Cannes: Taste of Cherry"। festival-cannes.com। ২০১১-০৮-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-২৩।
- ↑ Constantine Santas (২০০০)। "Concepts of Suicide in Kiarostami's Taste of Cherry"। Sense of Cinema। ৩ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০১৮।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে আব্বস কিয়রোস্তামি (ইংরেজি)
- আব্বস কিয়রোস্তামি — সেন্সেস অফ সিনেমা ডট কম
- রটেন টম্যাটোসে আব্বস কিয়রোস্তামি (ইংরেজি)
- আব্বাস কিয়রোস্তামি — দে শুট পিকচারস, ডোন্ট দে?
- আব্বাস কিয়রোস্তামি — নিউ ইয়র্ক টাইমস চলচ্চিত্র
- Abbas Kiarostami: Image, Voice and Vision, কনফারেন্সের এবস্ট্রাক্ট (২০০৫)
- আব্বস কিয়রোস্তামির সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ - ব্রাইট লাইটস ফিল্ম জার্নাল থেকে[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- আব্বাস কিয়রোস্তামি
- ১৯৪০-এ জন্ম
- ২০১৬-এ মৃত্যু
- ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক
- ইরানি চিত্রনাট্যকার
- ইরানি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা
- ইরানি কবি
- ইরানি চিত্রগ্রাহক
- ফার্সি ভাষার চলচ্চিত্র পরিচালক
- তেহরানের ব্যক্তি
- আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার বিজয়ী
- ফেলেনি স্বর্ণপদক বিজয়ী
- ইরানি চিত্রলৈখিক নকশা প্রণয়নকারী
- ইরানি মানবতাবাদী
- লেজিওঁ দনর প্রাপক
- ইরানি আলোকচিত্রী
- পারস্যবাসী
- তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- ফার্সিভাষী চলচ্চিত্র পরিচালক
- ইংরেজিভাষী চলচ্চিত্র পরিচালক
- ফরাসীভাষী চলচ্চিত্র পরিচালক
- ইতালীভাষী চলচ্চিত্র পরিচালক
- পাল্ম দর বিজয়ী
- পাল্ম দর বিজয়ী চলচ্চিত্রের পরিচালক
- ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র পরিচালক
- ফরাসি ভাষার চলচ্চিত্র পরিচালক
- ফ্রান্সে ক্যান্সারে মৃত্যু